লেখাটি স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের সদ্য পিআরএল-এ যাওয়া অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আহসান হাবিবের ফেসবুক ওয়াল থেকে নেয়া। আমাদের প্রকৌশল পাঠকদের জন্য হুবহ তুলে ধরা হলো।

আলহামদুলিল্লাহ।
আজ আমার সরকারি চাকরি জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটলো। মোট ১২১৭২ দিনের এক অনন্য সফর। বছরের হিসেবে ৩৩ বছর ৩ মাস ২৭ দিন ( ৮টা লিপইয়ারসহ)। ১৯৮৯ সালের ১ জুন প্রকাশিত এক প্রজ্ঞাপণের মাধ্যমে নিয়োগ পেয়ে ৮ জুন ৫/৭ লালমাটিয়া, ব্লক-বি তে অবস্থিত এলজিইবি সদর দপ্তরে যোগ দিই। আমাকে কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলায় পদায়ন করা হয়। ১৫ জুন শুরু হয় স্বপ্নমাখা এক নতুন জীবন।
সে সময় সড়ক পরিবহন ব্যবস্থা ছিলো খুবই নাজুক। ঢাকা থেকে খোকসা যেতে বাস, লঞ্চ আবার বাস, তারপর ট্রেন—সাত-আট ঘণ্টার ঝক্কি। ট্রেন যদি লেটে চলতো অথবা কোনো কারণে মিস হতো তাহলে বারো ঘণ্টাও লেগে যেতো। এমন পরিবহন ব্যবস্থার কারণে মন চাইলেও ঢাকা আসতে পারতাম না। ট্রেনিং বা প্রোগ্রেস রিভিউ মিটিং হলেই কেবল ঢাকা যাওয়ার সুযোগ মিলতো মাসে-দুমাসে একবার। ছুটি নিয়ে আসার সুযোগও ছিলো সীমিত। আর টেলিযোগাযোগ? সে আর এক ইতিহাস। ঢাকায় ট্রাঙ্ককলের সংযোগ পেতে বারো থেকে চব্বিশ ঘণ্টা, কখনও বা দুদিন, তিনদিন লেগে যেতো। এছাড়া তখন বাসায় বাসায় টেলিফোন সংযোগও ছিলো না। সংযোগ নিতে ডিমান্ড নোটের কতো কী ঝামেলা! তাই একবার খোকসা এলে ঢাকার সঙ্গে এক-দুমাসের যোগাযোগহীনতা।
মা রান্না করতে খুব পছন্দ করতো। খোকসা থেকে ঢাকা এলে পছন্দের খাবার তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়তো। বাসায় প্রায় সারাবছরই নানান রকম পিঠা বানানো হতো। শীতের সময় সবচেয়ে বেশি। যেহেতু একবার ঢাকা আসলে দ্বিতীয়বার কবে আসতে পারবো তার ঠিক ছিলো না, তাই যখনই পিঠা বানানো হতো, মা তার কিছু অংশ ফ্রিজে তুলে রাখতো, যদি হঠাৎ চলে আসি—সেই আশায়।
সেসব দিনে শবেবরাতে হালুয়া-চালের রুটি-মাংস রেঁধে পড়শিদের বাসায় বিতরণের রেওয়াজ ছিলো (এখনও হয়তো কিছু আছে)। বিকেলে বড় খাঞ্চায় খাবার সাজিয়ে সরপোশ দিয়ে ঢেকে, সরপোশটি কুশিকাটায় তৈরি ম্যাটে আচ্ছাদিত করে আশেপাশের বাসায় খাবার পৌঁছে দেওয়া হতো। চাকরিতে যোগদানের পর প্রথম শবেবরাত। বাসায় বরাবরের মতো নারকেলের নাড়ু, হালুয়া, বরফি, পিঠা বানানো হয়েছে। মা পথ চেয়ে বসে আছে—শবেবরাতের ছুটিতে নিশ্চয়ই আসবো; কিন্তু আসতে পারলাম না। এক সপ্তাহ পর যখন এলাম, মা ফ্রিজ থেকে হালুয়া-বরফি বের করে দিয়ে বললো, আমি ভাবছিলাম তুই ছুটিতে আসবি। এতো দেরি করলি কেন?
: কাজের ঝামেলা ছিলো মা, তাই আসতে পারি নাই।
: আরো কতো পিঠা বানাইছিলাম, শেষ হইয়া গেছে।
: এই তো অনেক আছে।
ফাউন্ডেশন ট্রেনিং শেষ করে ৯০ সালের ১৮ মার্চ কুমিল্লার বার্ড থেকে ঢাকা এসে পরদিনই খোকসা চলে যেতে হলো। দুমাস পর কাজে যোগ দিলাম। মার্চ মাস কনস্ট্রাকশন কাজের উপযুক্ত সময়। তাই ঢাকা ফিরতে দু-তিন সপ্তাহ দেরি হলো। এসে শুনলাম মার শরীরটা ভালো না অথচ ডাক্তারের কাছে যায়নি। জিজ্ঞেস করলাম, ডাক্তারের কছে যাও নাই কেন?
: তোর জন্য দেরি করতেছিলাম। তুই আসলে যামু।
: এইটা কোনো কথা বললা? টুটুল তো ছিলো। আমার আসতে যদি আরো দেরি হইতো!

মাকে খুব বেদনাক্লিস্ট দেখাচ্ছিলো। সেই সন্ধ্যায় মাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলাম।
মার খুব সখ ছিলো খোকসা যাবে। মাঝে মাঝেই বলতো, খোকসা গিয়া তোর ঘর-দোর গুছাই দিবো। কয়েকদিন থাকবো।
: চলো। কবে যাবা বলো?
: শরীরটা একটু ঠিক হইলেই যাবো।
মার আর খোকসা যাওয়া হয়নি। আমি তার বড়ো ছেলে। নিশ্চয়ই অনেক স্বপ্ন ছিলো আমাকে নিয়ে আর দশজন মধ্যবিত্ত গৃহিনীর মতো। কিন্তু চোখের স্বপ্ন চোখে নিয়েই চলে গেলো অনন্ত যাত্রায় আমার চাকরির মাত্র তের মাসের মুখে। আমি কী দুর্ভাগা সন্তান, মৃত্যু যাত্রায় মায়ের মুখে একফোঁটা পানি দেওয়ার সুযোগ পেলাম না! ঢাকা থেকে যখন তার শারীরীক অবস্থা অবনতির খবর পাঠানো হতো কুষ্টিয়ায়, সেই খবর আমি পেতাম না। ২৯ জুন রাতে ঢাকা থেকে পুলিশের ওয়্যারলেস যোগে থানায় খবর পাঠানো হলো—মা নেই। সেই খবর আমার কাছে গোপন রাখা হলো। পরদিন সকালে খোকসা কলেজের প্রভাষক, আমার পরম বন্ধু রানা ভাই (সম্প্রতি তিনি প্রয়াত হয়েছেন) আমাকে নিয়ে ঢাকা রওনা হলেন। পথেই পদ্মা পাড়ি দিয়ে এক আত্মীয়র সঙ্গে দেখা। তার কাছে জানতে পারলাম মা আর নেই। আমি পাগল হয়ে গেলাম।
এমন আরো অনেক দুঃখ-বেদনায়, সুখ-আনন্দে, মান-অভিমানে, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তিতে কীভাবে যে কেটে গেলো ৩৩টি বছর টেরই পেলাম না! সময়ের এই দীর্ঘ পরিক্রমায় অনেককিছু যেমন হারিয়েছি, প্রাপ্তির ঘরও নিতান্ত কম নয়। সবচেয়ে বেশি যেটা পেয়েছি তা হলো সহকর্মীদের আমার ওপর আস্থা ও বিশ্বাস, সহযোগিতা ও সহমর্মিতা, স্নেহ ও অকৃপণ ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা। যতোটুকু আমি পাওয়ার যোগ্য তার থেকে যাঁরা দিয়েছেন তাদের উদারতা ঢের বেশি। এতো ভালোবাসা, এতো ভালোবাসা—আমার জীবনের সব অপূর্ণতা পূর্ণ হয়ে গেছে। আমি পরম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় সকল সহকর্মীর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। আমার স্ত্রী-পুত্র-কন্যাসহ কাছের ও দূরের আত্মীয় বন্ধু-পরিজন সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি তাঁদের অমূল্য ও ধারাবাহিক সহযোগিতার জন্য। আর আমার বাবা, আমার পরমগুরু ও শিক্ষক, পাড়ার লোকের ‘নানা’…এখনও এলাকার মানুষের কাছে আমি ‘নানার বড়ো ছেলে’…আমৃত্যু এই পরিচয়েই থাকতে চাই।