অতিরিক্ত ওজনের পণ্যবাহী যান চলাচলের কারণে মহাসড়ক ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। নির্ধারিত আয়ুস্কালের অনেক আগেই সড়ক যানবাহন চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। এক্ষেত্রে সড়কের রক্ষণাবেক্ষণ ও পুনর্বাসনে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। এছাড়া অতিরিক্ত ওজন বহনকারী যানবাহনগুলোই সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় দেশের গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কে মোট ২১টি এক্সেল লোড নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে এক হাজার ৭৩৩ কোটি টাকা। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু এক্সেল লোড নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র স্থাপন করলেই সমস্যার সমাধান হবে না, সীমার মধ্যে পণ্য পরিবহনে আরও কঠোর হতে হবে সরকারকে।
সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, ১০ থেকে ২০ বছর পর্যন্ত আয়ুস্কাল ধরে বাংলাদেশের সড়কগুলোর নকশা করা হয়। এসব সড়কে ছয় চাকা পর্যন্ত ট্রাকের ক্ষেত্রে সাড়ে ১৫ টনের বেশি পণ্য পরিবহন না করার সরকারি গেজেটও রয়েছে। কিন্তু ২০ থেকে ৩০ টনের বেশি ওজনের ট্রাক বা কাভার্ডভ্যান চলাচল করে। সড়কে যান চলাচল নিরাপদ এবং সড়কগুলো মজবুত ও টেকসই রাখার উদ্দেশ্যে ওয়েব নির্ভর তদারকি পদ্ধতি এবং আধুনিক প্রযুক্তি সংবলিত এক্সেল লোড নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে।
গাজীপুর সদর, কেরানীগঞ্জ, ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট, শেরপুরের নালিতাবাড়ী, কুমিল্লার বুড়িচং, ফেনী সদর, চট্টগ্রামের সাতকানিয়া, চট্টগ্রাম সদর, সীতাকুণ্ড, হবিগঞ্জের মাধবপুর, সিলেটের বিয়ানীবাজার, বাগেরহাটের রামপাল, সাতক্ষীরা সদর, চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা, বগুড়ার শিবগঞ্জ, দিনাজপুরের হাকিমপুর, কুড়িগ্রামের রৌমারী, পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া, নীলফামারীর সৈয়দপুর, মাদারীপুরের শিবচর, টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলায় এসব এক্সেল লোড নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়।
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ড. শামসুল আলম বলেন, ট্রাক নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান বলে দিচ্ছে ছয় চাকার গাড়ির পণ্য পরিবহনের সক্ষমতা হবে ১৬ টন। ১০ চাকার গাড়ির ২৬ টন পর্যন্ত পণ্য পরিবহনের সক্ষমতা দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু বেশি মুনাফার আশায় এসব ট্রাক ও কাভার্ডভ্যানে ধারণ ক্ষমতার বেশি পণ্য পরিবহন করা হচ্ছে। এতে সড়কগুলো মেয়াদের আগেই নষ্ট হচ্ছে। রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় বাড়ছে। অতিরিক্ত ওজনের কারণে এসব ট্রাক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনা ঘটায়।
তিনি আরও জানান, নির্বাচনের আগে ছয় চাকার ট্রাকের ক্ষেত্রে ১৬ টনের পরিবর্তে ২২ টন পর্যন্ত পণ্য পরিবহনের ক্ষমতা দিয়েছে সরকার। ১০ চাকার গাড়ির ক্ষেত্রে ২৬ টনের পরিবর্তে ৩৬ টন পণ্য পরিবহনের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। ফলে বাংলাদেশের সড়কগুলোর নিম্নমানের জন্য সরকার কিছুতেই দায় এড়াতে পারে না। এ অবস্থায় শুধু এক্সেল লোড নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র করলেই হবে না। কঠোরভাবে অতিরিক্ত ওজনের যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) কর্মকর্তারা জানান, বর্তমানে ঢাকা-চট্টগ্রাম জাতীয় মহাসড়কের সীতাকুণ্ডের বড় দারোগারহাট এলাকায় এক্সেল লোড কন্ট্রোল স্টেশন রয়েছে। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, অধিকাংশ গাড়িই সরকার নির্ধারিত নিয়ম মানছে না। শুধু অধিক ওজনের পণ্যবাহী যানের কারণেই ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণের কাজ শেষ হতে না হতে সড়কটির বিভিন্ন স্থান দেবে গেছে। প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেও জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কটি টেকসই করা গেল না। মহাসড়কটি মেরামতে এবার প্রায় এক হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের আরেকটি প্রকল্পের প্রস্তাব করেছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ।
একই কারণে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মতো দেশের অন্যান্য আঞ্চলিক ও জাতীয় মহাসড়কগুলো নির্মাণের পর বেশি দিন টিকছে না। বছর না ঘুরতেই নতুন নির্মাণ করা সড়ক ভেঙেচুরে একাকার হয়ে পড়ছে। খানাখন্দ আর কার্পেটিং উঠে চলাচলের অযোগ্য হয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও অতিবৃষ্টি, সড়কে বৃষ্টির পানি জমে যাওয়া এবং ত্রুটিপূর্ণ ও মানহীন নির্মাণের কারণেও সড়ক টেকসই হচ্ছে না। কোনো কোনো সড়ক বাস্তবায়ন কাজ শেষ হওয়ার আগেই যানবাহন চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে।
সংশ্নিষ্টরা জানান, নীতিমালার আওতায় সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর দেশের বিভিন্ন স্থানে এক্সেল লোড নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র স্থাপন করেছে। এ নীতিমালা অমান্য করলে আর্থিক জরিমানাসহ শাস্তির ব্যবস্থাও রেখেছে সরকার। কোন ধরনের গাড়িতে সর্বোচ্চ কত পরিমাণ ওজন বহন করা যাবে সে বিষয়ে ‘মোটরযানের এক্সেল লোড নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র পরিচালনা সংক্রান্ত নীতিমালা’ রয়েছে। নীতিমালা অনুযায়ী সামনে দুই চাকা আর পেছনে চার চাকা আছে এমন গাড়ি সর্বোচ্চ সাড়ে ১৫ টন ভারবহন করতে পারবে। আট চাকার গাড়ি পারবে সোয়া ১৬ টন ও ১০ চাকার গাড়ি পারবে সোয়া ১৮ টন ভারবহন করতে। অন্যান্য গাড়ির ক্ষেত্রেও ওজনের সীমা নির্ধারণ করা রয়েছে।
সংশ্নিষ্টরা জানিয়েছেন, দেশের রাস্তাগুলো যে টেকসই হচ্ছে না তা খোদ সরকারের জরিপেও উঠে আসছে। রাস্তার মান নিয়ে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের হাইওয়ে ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট (এইচডিএম) সার্কেল রোড রাফনেস সার্ভে করে থাকে। সর্বশেষ জরিপ করা হয়েছে ২০১৭ সালের নভেম্বর থেকে ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত। জরিপে দেশের সড়কগুলোকে ভালো, মোটামুটি, নিম্নমান, খারাপ ও খুব খারাপ এই পাঁচ ভাগে ভাগ করা হয়েছে। তাতে দেখা গেছে, দেশের ২১ দশমিক ২৫ শতাংশ জাতীয় মহাসড়ক খারাপ ও খুব খারাপ মানের। ২০১৬ সালের আগস্টে প্রকাশিত এইচডিএমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, দেশের ২০ দশমিক ৩৯ শতাংশ জাতীয় মহাসড়ক খারাপ মানের। আঞ্চলিক ও জেলা সড়কের মান আরও খারাপ। ২০১৬ সালের জরিপে দেখা যায়, দেশের জেলা শহরগুলোর প্রায় ৪৭ শতাংশের বেশি সড়ক কোনো না কোনোভাবে ভাঙাচোরা অবস্থায় রয়েছে।
দেশে বিভিন্ন শ্রেণির সড়কের মোট দৈর্ঘ্য ২১ হাজার ৩০২ কিলোমিটার। এর মধ্যে জাতীয় মহাসড়কের দৈর্ঘ্য যথাক্রমে ৩ হাজার ৮১৩ কিলোমিটার। ৪ হাজার ২৪৭ কিলোমিটার আঞ্চলিক মহাসড়ক। এছাড়া বাকি ১৩ হাজার ২৪২ কিলোমিটার জেলা সড়ক।