♦ আমাদের প্রকৌশল ডেস্ক
সরকারের স্থানীয় পর্যায়ে এই সমীকরণেই চলছে উন্নয়নকাজ। স্থানীয় পর্যায়ে ঠিকাদারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভাগের প্রকৌশলীর গাঁটছড়া ঠিক থাকলে কাজ হয় স্বাভাবিক গতিতে। তবে অনিয়ম-দুর্নীতি হয়ে যায় প্রকল্পের অনুষঙ্গ। এর সঙ্গে স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ জড়িত থাকলে অনিয়ম-দুর্নীতি দুটোই বাড়ে।
বিপরীত চিত্রও আছে। স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনীতিক আর প্রকৌশলীর মধ্যে বনিবনা না থাকলে উন্নয়নকাজ ব্যাহত হতে থাকে। কিন্তু রাজনীতিকদের মধ্যে বিভক্তি থাকলে প্রকৌশলী সুবিধামতো অংশের সমর্থন নিয়ে ক্ষমতাবান হয়ে ওঠেন। তখন প্রকৌশলী তাঁর ঊর্ধ্বতনকেও পরোয়া করেন না।
কিন্তু ঠিকাদার আর প্রকৌশলীর মধ্যে যদি বনিবনা না থাকে এবং ঠিকাদার নিজেই রাজনীতিতে যুক্ত থাকেন তাহলে প্রকৌশলীর কপালে লাঞ্ছনা তো জুটবেই। মাঝে মাঝে মারও খেতে হয়। চলতি বছর সারা দেশে এমন ৮২ প্রকৌশলীকে মারধর ও লাঞ্ছনার শিকার হতে হয়েছে।
এই মারধরের ঘটনা অনুসন্ধান করতে গিয়ে ওপরের এই সমীকরণগুলো পাওয়া গেল। এতে প্রায় সব ক্ষেত্রে উন্নয়নকাজ ব্যাহত হচ্ছে। বাড়ছে অনিয়ম-দুর্নীতি। সম্প্রতি সরকারি দপ্তরে কাজ করা প্রকৌশলীদের সংস্থাগুলো ঠিকাদারদের হাতে তাঁদের সদস্যদের মার খাওয়া নিয়ে সোচ্চার হয়েছেন। তাঁরা স্থানীয় সরকার মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করে আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে চিঠি দিয়ে ‘উন্নয়নকাজ নির্বিঘ্ন রাখতে’ প্রকৌশলীদের নিরাপত্তা চেয়েছেন। সুষ্ঠু বিচার ও শাস্তি চেয়েছেন অভিযুক্ত ঠিকাদারদের।
ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ (আইইবি) ও ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স (আইডিইবি) সারা দেশে কর্মরত প্রকৌশলীদের দুই সংগঠন। তাদের তথ্য, চলতি বছর দেশের বিভিন্ন স্থানে ৮২ জন প্রকৌশলী হামলা, মামলা ও শারীরিক নির্যাতনের স্বীকার হয়েছেন। এর মধ্যে ৪৫ জন প্রকৌশলী আইইবির। ৩৭ জন ডিপ্লোমা প্রকৌশলী।
পাল্টা হিসেবে প্রকৌশলীরাও স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। বিপরীতে জনপ্রতিনিধি ও ঠিকাদাররা প্রকৌশলীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ এনে সংশ্লিষ্ট বিভাগের কাছে তাঁদের সরিয়ে নেওয়ার আবেদন করেছেন।
জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ বলেন, দেশে স্বাধীনভাবে কোনো টেন্ডার হচ্ছে না। ফলে পেশাদার ঠিকাদাররা কাজ পাচ্ছেন না। অপেশাদার ঠিকারদাররা কাজ না বুঝায় প্রকৌশলীরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রকৌশলীরা সুযোগও নিচ্ছেন। তিনি আরো বলেন, উপজেলা পরিষদ আইন ও আরপিও অনুযায়ী, জনপ্রতিনিধিরা লাভজনক পদে থেকে নিজ এলাকায় কাজ করতে পারেন না। যদি কোনো জনপ্রতিনিধির ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান থাকে তাহলে তিনি নিজ এলাকার বাইরে কাজ করতে পারবেন।
ঠিকাদার–রাজনীতিবিদ–প্রকৌশলী
বিভিন্ন এলাকার প্রায় ৫০ জন ঠিকাদার, জনপ্রতিনিধি ও প্রকৌশলীর সঙ্গে কথা বলে যে চিত্র উঠে এসেছে তা হলো—অনেক জেলা-উপজেলায় জনপ্রতিনিধিরা স্ত্রী, সন্তানের নামে লাইসেন্স করে ঠিকাদারি করছেন। কিছু প্রকৌশলী স্থানীয় এই জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে মিলেমিশে থাকছেন এবং একই কর্মস্থলে বছরের পর বছর আছেন। জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকা এই প্রকৌশলীরা কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকারের বদলির আদেশও মানছেন না।
এই সমস্যা নিরসনে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী একাধিকবার চিঠিও দিয়েছেন। এমন একটি চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘… লক্ষ করা যাচ্ছে, বদলির আদেশ পাওয়ার পর কর্মস্থলে যোগদান না করে আদেশ পরিবর্তন, সংশোধন, বাতিলের জন্য বিভিন্ন মহল থেকে তদবির করে প্রশাসনিক জটিলতা সৃষ্টি করছেন, যা সরকারি কর্মচারী আচরণবিধি পরিপন্থী। এমনকি তাত্ক্ষণিক বদলি বা স্ট্যান্ড রিলিজ করা হলেও কর্মস্থলে যোগদান থেকে বিরত থাকেন এবং আদেশ বাতিলের জন্য বিভিন্ন মহল থেকে চাপ সৃষ্টি করেন। ’ এসব আদেশ না মানলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয় চিঠিতে।
ঠিকাদার–প্রকৌশলী মারধর, লাঞ্ছনা
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর এলজিইডির পটুয়াখালী সদর উপজেলা প্রকৌশলী (বর্তমানে বাগেরহাটের ফকিরহাট উপজেলায় কর্মরত) আজিজুর রহমানকে গত এপ্রিলে স্থানীয় ঠিকাদার ও জনপ্রতিনিধির লোকজন মারধর করেন। তিনি সদর উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান সৈয়দ মো. সোহেলকে এক নম্বর আসামি করে থানায় মামলা করেন।
এজাহারে বলা হয়, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান সোহেল একটি স্কুল নির্মাণের কাজ পেয়েছেন। তিনি স্কুলের বালু ভরাটের কাজ করেছেন। কিন্তু পাইলের কাজ না করে ‘করা হয়েছে মর্মে’ সার্টিফিকেট চান। তা না দেওয়ায় তাঁকে মারধর করা হয়েছে।
এ ঘটনায় বরিশাল বিভাগের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীর নেতৃত্বে তদন্ত কমিটি করা হয়। তদন্তের পর সৈয়দ মো. সোহেলের ঠিকাদারি লাইসেন্স ও কাজ বাতিল করা হয়। তিনি আদালতে যান এবং আদালত এ আদেশ স্থগিত করেন।
সৈয়দ সোহেল বলেন, তৃতীয় পক্ষের উসকানিতে উপজেলা প্রকৌশলী মামলা করেছিলেন। পরে বিষয়টি আদালত থেকে সমাধান হয়েছে। উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান হয়ে ঠিকাদারি কাজ করতে পারেন কি না জানতে চাইলে তিনি আরো বলেন, ‘এখন ডিসি কার্যালয়ের দরবার হলে আছি। ’
গত মার্চে পটুয়াখালীর দুমকী উপজেলায় হামলার শিকার হন এলজিইডির উপজেলা প্রকৌশলী নাজিম উদ্দীন ও উপসহকারী প্রকৌশলী আব্দুস সালাম। পটুয়াখালী ও বরিশালকে সংযোগকারী নির্মাণাধীন পাগলা সেতুর সাইট পরিদর্শনে যান। তিনি কাজের পরিমাণের ভিত্তিতে বিল দেওয়া হবে বলে জানান। এরপরই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কিউসিকেকে-জেবির কর্মী গোলাম হোসেন সারোয়ার তাঁকে লাঞ্ছিত করেন। এরপর প্রকৌশলী থানায় মামলা করেন।
পটুয়াখালী জেলার নির্বাহী প্রকৌশলী জি এম সাহাবুদ্দিন বলেন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা স্ত্রী, সন্তানের নামে লাইসেন্স করে কাজ নিচ্ছেন। তাঁদের চাপে স্বাধীনভাবে দরপত্র (টেন্ডার) আহ্বান বা প্রকল্প কাজ করা যায় না।
গত এপ্রিলে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাটে প্রতিবেদন ঠিকাদারের পক্ষে না যাওয়ায় এলজিইডির প্রকৌশলী সাজেদুল ইসলামকে মারধর করা হয়। গত ৭ আগস্ট মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলা প্রকৌশলী আমিনুল ইসলামের কার্যালয়ে হামলা করেন ঠিকাদাররা। ১৮ আগস্ট রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলার প্রকৌশলী সানোয়ারের বাসভবনে হামলা হয়। সব কটি ঘটনায় হামলার পেছনে ছিলেন স্থানীয় ঠিকাদাররা। প্রকৌশলীরা তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন।
সম্প্রতি চাঁদপুরের কচুয়ায় উপসহকারী প্রকৌশলী নূর আলম হামলার শিকার হন। এর জন্য উপজেলা চেয়ারম্যান শাহজাহানকে আসামি করে মামলা হয়। মাগুরার উপসহকারী প্রকৌশলী জাহিদুল ইসলাম, চট্টগ্রাম ফটিকছড়ির বিশ্বসূত্র ধর, মেহেরপুর সড়ক ও জনপথ বিভাগের উপসহকারী প্রকৌশলী অনুজ কুমার দে, রাজশাহী গণপূর্ত বিভাগ-২ কার্যালয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন ও পাবনা গণপূর্ত বিভাগের উপসহকারী বিভাগীয় প্রকৌশলী আব্দুস সাত্তার হামলার শিকার হয়েছেন।
আগস্টে শেরপুর জেলা এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে ঘুষ-দুর্নীতির অভিযোগ করেন ঠিকাদাররা। আর ঠিকাদারের বিরুদ্ধে কাজ না করে বিল চেয়ে প্রাণনাশের হুমকির অভিযোগ করেন নির্বাহী প্রকৌশলী। এ নিয়ে এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী ও জেলা ঠিকাদার সমিতি পাল্লাপাল্টি সংবাদ সম্মেলন করেছে।
শেরপুর জেলা ঠিকাদার সমিতির বর্তমান সভাপতি ছানুয়ার হোসেন ছানু শেরপুর সদর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান। ছানুয়ার হোসেন ছানু কালের কণ্ঠকে বলেন, জেলা-উপজেলার প্রকৌশলীরা যেকোনো কাজের জন্য কমিশন দিতে বাধ্য করছেন। সংশ্লিষ্ট পিডিদের (প্রকল্প কর্মকর্তা) ফান্ডে টাকা না দিয়ে কাজের বিল পাওয়া যায় না। বিভিন্ন অজুহাতে প্রকৌশলীরা ঠিকাদারদের কাছ থেকে টাকা বের করে নিচ্ছেন।
আবার হামলার শিকার ভোলাহাট উপজেলা এলজিইডির উপজেলা প্রকৌশলী সাজেদুল ইসলাম বলেন, যাঁরা কাজ পাচ্ছেন না তাঁরা অফিসে এসে হামলা করছেন। মাঠ পর্যায়ে প্রকৌশলীর চাকরি করা মুশকিল হয়ে গেছে। সততা নিয়ে কাজ করা কঠিন। প্রায় একই কথা বললেন বাগেরহাট, পটুয়াখালী, রাজশাহীর প্রকৌশলীরা।
ব্যাহত হচ্ছে উন্নয়নকাজ
স্থানীয় পর্যায়ে প্রকৌশলী, ঠিকাদার ও জনপ্রতিনিধিদের দ্বন্দ্বের কারণে উন্নয়নকাজ ব্যাহত হচ্ছে। আবার তাঁদের মধ্যে সখ্যের কারণে প্রকল্প ব্যয় বাড়ছে। অনিয়ম, দুর্নীতি বাড়ছে।
উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়নে অবকাঠামোর তথ্যভাণ্ডার, ম্যাপ, কারিগরি বিনির্দেশ (টেকনিক্যাল স্পেসিফিকেশন), ম্যানুয়াল সঠিকভাবে তৈরি করতে পারছেন না বলে দাবি করেছেন প্রকৌশলীরা। বেশির ভাগ স্থানে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও ঠিকাদারদের ইচ্ছায় প্রকল্প প্রণয়ন করতে হচ্ছে।
নেত্রকোনায় ৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে ১১টি সেতু নির্মিত হয়েছে। কিন্তু সংযোগ সড়ক না করায় চারটি সেতু কোনো কাজে আসছে না। আবার রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ ও ফরিদপুরের সদর উপজেলায় প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলেও নির্মিত হয়নি সেতু। বাঁধ নির্মাণে অনিয়মের ফলে প্রতিবছর হাওর এলাকায় নষ্ট হচ্ছে কৃষকের ফসল। প্রকৌশলী, ঠিকাদার ও জনপ্রতিনিধিদের সখ্যের কারণে এ ধরনের অনেক প্রকল্প দুর্নীতির প্রতীক হয়ে উঠছে।
সংশ্লিষ্টরা যা বললেন
আইইবি সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী শাহাদাৎ হোসেন শিবলু বলেন, স্থানীয় পর্যায়ে প্রকৌশলীদের হয়রানির ঘটনাগুলো স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে জানানো হয়েছে। এরপর কিছু জায়গায় ঠিকাদারদের গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। তাঁদের লাইসেন্স বাতিলের মতো ব্যবস্থা নেওয়াও প্রয়োজন। এ জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রীকেও জানানো হয়েছে।
আইডিইবির প্রেসিডেন্ট এ কে এইচ এ হামিদ বলেন, যাঁরা মানসম্মত কাজ না করে জোর করে বিল নিতে চান তাঁরা প্রকৌশলীদের হয়রানি করছেন।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেন, প্রকৌশলীদের হয়রানির ঘটনাগুলো হালকা করে দেখা হচ্ছে না। তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। অনেক জনপ্রতিনিধিকে বরখাস্তও করা হয়েছে। তিনি বলেন, এমন অভিযোগ আগে আরো বেশি ছিল। এখন কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে।
এসব ঘটনা কেন ঘটছে—জানতে চাইলে মন্ত্রী আরো বলেন, এর সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ বলা যায় না। এটা ব্যক্তিগত কারণে হতে পারে। বদলি আদেশ অমান্যের বিষয়ে তিনি বলেন, কোনো কর্মকর্তা একই কর্মস্থলে পাঁচ বছরের বেশি থাকলে বদলি করা হচ্ছে। বদলি আদেশ মানবেন না এটা হতে পারে না। তবে অনেক সময় স্থানীয় সংসদ সদস্যদের অনুরোধে রাখা হয়।